জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ <br> কী? কেন? কীভাবে?

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ
কী? কেন? কীভাবে?

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর পূর্বে মহাকাশের সবচেয়ে দূরের তারাগুলো পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিল হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী জগতে হাবল স্পেস টেলিস্কোপেরও আয়ু ফুরিয়ে এলো বলে। তাই এর উত্তরসূরি হিসেবে এবার পৃথিবীর সাপেক্ষে মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরের তারাগুলো আরো স্পষ্ট করে দেখতে আকাশপানে উড়াল দিবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। 

১৯৯৬ সালে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ লঞ্চ হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারিগরি জটিলতার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। এই প্রজেক্টটির মূল দায়িত্বে আছে NASA। তবে নাসাকে নানা সহায়তা দিয়ে সাহায্য করছে ESA (European Space Agency) ও CSA (Canadian Space Agency)। নাসার দেওয়া সর্বশেষ ঘোষণা মতে এ বছরের ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ লঞ্চ হতে যাচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। এটিকে রাখা হবে আমাদের পৃথিবী থেকে ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরের এল২ ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্টের কাছাকাছি। বলে রাখা ভালো, সূর্য-গ্রহ সিস্টেমে এমন ৫টি পয়েন্ট থাকা সম্ভব যেখানে ওই গ্রহ ও সূর্যের মহাকর্ষীয় প্রভাবের সাথে কক্ষীয় গতির সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে ওই পয়েন্টে রাখা কোনো বস্তুর অবস্থান সূর্য ও ওই গ্রহের সাপেক্ষে সবসময় একই থাকে। এল-২ ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান পয়েন্ট এমনই একটি পয়েন্ট। 

এল২-এর কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও ১০ বছর চলতে পারবে এইটুকু পরিমাণ জ্বালানি নিয়ে মহাকাশে যাচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। প্রথমদিকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ১৫ বছরের জন্য কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হলেও ইঞ্জিনিয়ারদের বুদ্ধি ও কৌশলের কারণে তা এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে। একইভাবে ওয়েব-এর জীবনসীমাও বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে ধারণা করছেন কোনো কোনো ইঞ্জিনিয়ার।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে কী করা হবে?

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে আসলে অনেক কাজই করা সম্ভব হবে। তবে এর মূল কাজ তিনটি।

১. শিশু মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ:  কোনো বস্তু থেকে আলো আসলে আমরা ওই বস্তুকে দেখতে পাই। বহুদূরের কোনো বস্তু থেকে আলো আসতে আসতে অনেক সময় লাগে। তাই যত দূরের বস্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমরা আসলে সেই বস্তুকে তার তত বেশি অতীতের অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে মূলত দূর মহাবিশ্বের এই বস্তুগুলোকে তাদের অতীতের অবস্থায়ই  দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, এই টেলিস্কোপটির সরঞ্জাম এতটা  উন্নত ছিল না যে এর সাহায্যে খুব স্পষ্টভাবে বহু দূরের নক্ষত্রগুলো দেখা যাবে। অন্যদিকে আমাদের মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে অনেক দূরের নক্ষত্র থেকে আসা আলোরও রেড শিফট হচ্ছে। কোনো নক্ষত্র যত দূরে সেটি তত বেশি অবলোহিত অঞ্চলের আলো বিচ্ছুরণ করে। সেটিকে আর দৃশ্যমান অঞ্চলের আলো বিচ্ছুরণ করতে দেখা যায় না। কিন্তু হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে তড়িত-চৌম্বকীয় বর্ণালীর কেবল দৃশ্যমান অঞ্চল ও নিকট অবলোহিত অঞ্চলই দেখা যায়। তাই আমাদের এমন একটা টেলিস্কোপ প্রয়োজন যা দিয়ে অবলোহিত অঞ্চলের আলো স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়েই তৈরী করা হয়েছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।

২. এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ:  আমাদের সৌরজগতের বাইরে থাকা গ্রহগুলো তথা এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর বায়ুমণ্ডল তার নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে আসা কিছু আলো শোষণ করে নেয়। ফলে ওই এক্সোপ্ল্যানেটের শোষণ বর্ণালি বিশ্লেষণ করলে ওই বায়ুমণ্ডলে কী কী পদার্থ আছে  জানা যায়। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে এমনই একটি অতি সংবেদনশীল স্পেকট্রোগ্রাফ রাখা হয়েছে যা দিয়ে এই শোষণ বর্ণালি খুব সহজে ও অতি সূক্ষ্মতার সাহায্যে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এতে ব্যবহার করা স্পেকট্রোগ্রাফের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দিয়ে একই সাথে ১০০টি জ্যোতিষ্কের বর্ণালী বিশ্লেষণ করা সম্ভব। কোন কোন এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পদার্থ আছে তাও খোঁজার কাজ করবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। উল্লেখ্য, এর আগে কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে এক্সোপ্ল্যানেট খোঁজার খুব দুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হয়েছে।  

৩. গ্যালাক্সি ও ডার্ক ম্যাটার:  যেহেতু ওয়েব টেলিস্কোপ অনেক দূরের বস্তুকে দেখতে পায়, তাই এটি অতীতকেও দেখতে পায়। অর্থাৎ ওই বস্তুগুলোকে তাদের অতীতের অবস্থায় দেখতে পায়। সেহেতু এটির সাহায্যে গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র গঠিত হতে দেখা যাবে। সেখান থেকে আমাদের গ্যালাক্সি কীভাবে তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাবে। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলগুলোকে অবলোহিত অঞ্চলে দেখবে এ টেলিস্কোপ। একই সাথে গ্যালাক্সির মধ্যে থাকা ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণেও কাজ করবে এ টেলিস্কোপ।

তথ্যসূত্র
[১] Early Universe
[২] James Webb Space Telescope Launch Delayed to Christmas Eve or Later
[৩] The observatory

লেখক –
কে. এম. শরীয়াত উল্লাহ,
শিক্ষার্থী, ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Leave a Reply