বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আমরা প্রায় সময় গ্যালাক্সি, নেবুলা, অথবা ব্ল্যাক হোলের অনেক নান্দনিক ছবি দেখতে পাই। এছাড়া পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাবিশ্বকে কেন্দ্র করে নির্মাণ হওয়া ‘Gravity’, ‘Interstellar’, ‘2001: A Space Odyssey’ এর মতো সিনেমাও আমরা অনেকে দেখেছি। মহাবিশ্বের বিশালত্ব মানুষকে বরাবরই কৌতূহলী করে তুলেছে। অস্তিত্বের অর্থ খুঁজতে মানুষ যুগ যুগ ধরে এই মহাবিশ্বের দিকেই দৃষ্টিপাত করেছে। এই কৌতূহল মানুষের চিন্তাকে নিয়ে গেছে ১৩.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের GN-z11 গ্যালাক্সি পর্যন্ত।
কখনো মানুষের এই অনুসন্ধানী আগ্রহ মহাবিশ্বকে বানিয়েছে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বয়সের প্রবীণ! এই কঠিন কাজ সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র শক্তিশালী টেলিস্কোপে তোলা ছবি আর দৃশ্যমান তথ্যের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, “মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে, ছবি আমাদেরকে এমন প্রশ্ন করতে বাধ্য করে, যা আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকে স্পর্শ করে।”
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির আবির্ভাব
১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভাব ঘটে অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। যারাই ছিলেন প্রথম অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি বিকাশের পথপ্রদর্শক। অপেশাদার জ্যোতির্বিদ্যা হলো একধরনের শখ যেখানে অংশগ্রহণকারীরা দূরবীন বা টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আকাশের স্বর্গীয় বস্তু পর্যবেক্ষণ বা ছবি তোলা উপভোগ করেন। অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহাণু, ধুমকেতু, ছায়াপথে সুপারনোভার মতো ক্ষণস্থায়ী জ্যোতির্বিদ্যার ঘটনা আবিষ্কার করে সিটিজেন সায়েন্সে অবদান রেখে চলেছেন। অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনেকে মজা করে ভদ্র বিজ্ঞানীও বলে থাকেন।
ড্রেপার দ্বারা চাঁদের প্রাচীনতম বেঁচে থাকা ডেগাররোটাইপ (বামে) এবং
প্রথম সূর্যগ্রহণের ডেগাররোটাইপ ছবি (ডানে)
১৮৩৯ সালে চাঁদের প্রথম ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলেন লুই জ্যাক মান্ডে দাগুয়ের। এটা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানে ফটোগ্রাফির প্রথম প্রচেষ্টা। কিন্তু দীর্ঘ এক্সপোজারের সময় টেলিস্কোপের ট্র্যাকিং ত্রুটির ফলে ফটোগ্রাফটি অস্পষ্ট ছিল। পরবর্তীতে ১৮৪০ সালে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির রসায়নের অধ্যাপক জন উইলিয়াম ড্রেপার ২০-মিনিট-দীর্ঘ ড্যাগুয়েরোটাইপ ছবি তোলেন; যেটা চাঁদের প্রথম সফল ফটোগ্রাফ। ৫ বছর পর ১৮৪৫ সালে ফরাসি পদার্থবিদ লিওন ফুকো এবং হিপোলাইট ফিজেউ সূর্যের প্রথম ড্যাগুয়েরোটাইপ ছবি তোলেন; প্রথম সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ ফটোগ্রাফিক প্রক্রিয়া।
১৯ শতকের শেষের দিকে ড্রাই প্লেট ফটোগ্রাফির প্রবর্তন ঘটে। ড্রাই প্লেট হলো জেলটিন সিলভার প্রক্রিয়া যা সাদা-কালো ফটোগ্রাফিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রাসায়নিক প্রক্রিয়া। যদিও শুরুর দিকে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ফটোগ্রাফি গুরুতর গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেনি। এটি সর্বপ্রথম স্যার উইলিয়াম হাগিন্স এবং তার স্ত্রী মার্গারেট লিন্ডসে হাগিন্স দ্বারা ১৮৭৬ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বস্তুর বর্ণালী রেকর্ড করার কাজে ব্যবহার করে হয়েছিল। পরে ১৮৮০ সালে হেনরি ড্রেপার অ্যালভান ক্লার্ক দ্বারা তৈরি ১১ ইঞ্চি (২৮ সেমি) প্রতিসরাঙ্ক দূরবীন দ্বারা ফটোগ্রাফিকভাবে সংশোধন করা নতুন ড্রাই প্লেট প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ওরিয়ন নেবুলার ৫১ মিনিটের এক্সপোজার তৈরি করেছিলেন, যেটা ছিল নীহারিকার প্রথম ছবি।
হেনরি ড্রেপারের 1880 সালে প্রথম তোলা ওরিয়ন নেবুলার ছবি।
২০ শতকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী প্রতিসরণকারী টেলিস্কোপ এবং অত্যাধুনিক বৃহৎ প্রতিফলন টেলিস্কোপগুলোর বিশেষভাবে ব্যবহার শুরু হয়।
জ্যোর্তিবিজ্ঞানের গবেষনা নতুন মাত্রা পেয়েছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের ব্যবহার শুরুর পর থেকে। মহাকাশে ভাসমান পৃথিবীর প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নাম হলো হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল স্পেস শাটল ডিসকভারি দিয়ে এটিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে পাঠানো হয়। হাবল তার তোলা প্রথম ছবিটি পাঠিয়েছিলেন ১৯৯০ সালের ২০ মে। সেটা ছিল স্টার ক্লাস্টার NGC 3532 এর একটি দৃশ্য। হাবল টেলিস্কোপ বর্তমানে গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং জ্যোতির্বিদ্যার জনসংযোগের মধ্যস্থতা কারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হাবল টেলিস্কোপটির নামকরণ করা হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের নামে এবং এটি নাসার গ্রেট অবজারভেটরিগুলির মধ্যে একটি।
হাবলের তোলা প্রথম ছবি। (১৯৯০)
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফিকে আরো বেশি বিকশিত করেছে মহাকাশ অভিযানগুলো। মহাকাশে পাঠানো হাবল স্পেস টেলিস্কোপ অনেক স্পষ্ট এবং বিশাল ক্ষেত্রের ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে। দূরবর্তী গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, সুপারনোভা এছাড়া আরো মহাজাগতিক ঘটনাবলীর ছবি তুলতে সাহায্য করেছে এই টেলিস্কোপ।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ
কেন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি প্রয়োজন?
এখনও মনে হতেই পারে, কেন শতাব্দী ধরে মানুষ শুধু অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির উন্নয়নে এত উৎসাহী?
- প্ল্যানেট ট্রানজিট পদ্ধতির মাধ্যমে নতুন গ্রহ শনাক্ত করা সম্ভব। একটি নক্ষত্রের সামনে দিয়ে যখন একটি গ্রহ গমন করে তখন নক্ষত্রের উজ্জলতা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়, ফলে নক্ষত্রটির উজ্জলতা কমে গেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। কতটুকু উজ্জলতা কমেছে সে মান থেকে গ্রহটির পর্যায়কাল, গ্রহের ব্যাসার্ধ, ভর এসব বের করা সম্ভব। এই আবিষ্কারগুলো সম্ভব হয় শুধুমাত্র শক্তিশালী টেলিস্কোপে ধারন করা ছবির বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
- নক্ষত্রের জন্ম ও মৃত্যুর প্রক্রিয়া এবং গ্যালাক্সির বিবর্তন, মহাবিশ্বের গঠন বুঝতে অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি সহায়তা করে। নতুন গ্যালাক্সির সন্ধানের ফলে সৌরজগতের ভবিষ্যৎ, ব্ল্যাকহোলের প্রভাব, মানব সভ্যতার ইতিহাস জানা সম্ভব হচ্ছে।
- গ্রহাণু বলতে সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকা ধূমকেতু অথবা কোনো গ্রহের ধ্বংসাবশেষকে বোঝায়। গ্রহাণু যদি পৃথিবীর দিকে আসে তাহলে তা পৃথিবীবাসীর জন্য হুমকি স্বরুপ। তাই নিরাপত্তার জন্য সেগুলো শনাক্ত করা আবশ্যক। কিন্তু এই কাজটি করার জন্য প্রয়োজন ইমেজ নিয়ে কাজ করা। আর সেটাও সম্ভব হচ্ছে এস্ট্রোফটোগ্রাফির কারণেই।
একটি গ্রহাণুর ছবি
- জ্যোর্তিবিজ্ঞানে মানুষকে আগ্রহী করতে অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির জুড়ি নেই। বিভিন্ন ইমেজ প্রসেসিং সফটওয়্যার দিয়ে মহাবিশ্বের অনেক নান্দনিক ছবি বানানো হচ্ছে; যা দেখে অনেকে জ্যোর্তিবিদ্যা নিয়ে কাজ করার উৎসাহ পায়।
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির ধ্বজাধারী
যুগে যুগে বহু বিজ্ঞানী, গবেষক অথবা অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখে গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ডক্টর ক্যানন। যার গবেষনা এবং আবিষ্কারের পিছনের মূল ভিত্তি ছিল অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফ।
অ্যানি জাম্প ক্যানন যার আরেক নাম ‘আকাশের আদমশুমারি গননাকারী’। ডক্টর ক্যানন জীবদ্দশায় ৩০০টি পরিবর্তনশীল তারা এবং পাঁচটি নোভা আবিষ্কার করেছেন। এছাড়া ম্যানুয়ালি ৩৫০,০০০ নক্ষত্র তালিকাভুক্ত করার জন্য কৃতিত্ব আছে তার। ক্যাননের কাজের বৃহত্তর অংশ জুড়ে ছিল জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ফটোগ্রাফ অধ্যয়ন করা। অর্থাৎ অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফিকেছাড়া যেন জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়ন নিছক কল্পনামাত্র।
অ্যানি জাম্প ক্যানন
( Credit : American Philosophical Society)
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির ধরন
অনেক ধরনের অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির মধ্যে বিশেষ ২ ধরনের অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি অন্যতম।
১) টাইম ল্যাপস ফটোগ্রাফি: একই জায়গার ছবি দীর্ঘ সময় ধরে তোলে, তারপর স্থির চিত্রগুলোকে একসাথে যুক্ত করে একটি ছবিতে রুপ দেওয়ার যে পদ্ধতি সেটাকে টাইম ল্যাপস বলে। এই ফটোগ্রাফিকে স্টার ট্রেইলও বলা হয়। স্টার ট্রেইল ফটোগ্রাফগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ পর্যবেক্ষণের জন্য একটি অবস্থানের গুণমান নির্ধারণ করতে ব্যবহার করে। টেলিস্কোপ মাউন্টিং সিস্টেমে কম্পন পরিমাপ করতেও এর ব্যবহার করা হয়।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীর কক্ষপথে স্টার ট্রেইলের ছবি তোলা
Photo Credit : This Star Trails was taken by
an astronaut on board the ISS
২) প্ল্যানেটারি ফটোগ্রাফি: এটি হলো গ্রহ, চাঁদ, গ্রহাণু এবং অন্যান্য সৌরজগতের অবজেক্টগুলোর ছবি তোলার প্রক্রিয়া। এই ধরণের ফটোগ্রাফি সাধারণত শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে তোলা হয়। ফলে উচ্চ রেজোলিউশনের ছবি এবং ভিডিও পাওয়া যায়। এইগুলো গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। এই ফটোগ্রাফি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মহাকাশ গবেষকদের জন্য বিশেষভাবে মূল্যবান।
Photo Credit: National Astronomical Observatory
of Japan (NAOJ)
অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফিকে আরো সমৃদ্ধ করি
James Webb Space Telescope (JWST) এর মতো আরো বেশি শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে আরও গভীর মহাবিশ্বের চিত্র ধারণ করা সম্ভব। যার ফলে আমাদের ছায়াপথের বাইরের গ্যালাক্সি এবং তারকাদের গঠন বুঝতে সাহায্য করবে।
সাধারণ মানুষের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম সহজলভ্য করতে হবে। যেন অপেশাদার জ্যোতিবিজ্ঞানীরা সিটিজেন সায়েন্সে অবদান রাখতে পারে।
অটোমেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেলিস্কোপগুলিকে দূর থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। যা কম সময়ে অনেক বেশি ডেটা সংগ্রহ করতে সক্ষম। এই ধরনের এস্ট্রোফটোগ্রাফ জ্যোর্তিবিজ্ঞানের গবেষনাকে যেন বহুলাংশে সহজ করছে। এস্ট্রোফটোগ্রাফি আমাদের মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে দ্বার খুলে দিয়েছে।
Photo Credit : Peter Kennett (2005)
তথ্যসূত্র:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hubble_Space_Telescope
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Astrophotography
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Amateur_astronomy
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Daguerreotype
– কাজী তাসমিয়া বিনতে ইমাম
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ,
সেশন: ২০২১-’২২, শাবিপ্রবি।