তারার নিয়মাবদ্ধ শ্রেণীবিভাগ

তারার নিয়মাবদ্ধ শ্রেণীবিভাগ

জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিস্তর গবেষণার ক্ষেত্র, নাক্ষত্রিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে শুরু করবো আমাদের আজকের যাত্রা; শিখবো কিভাবে ৭টি শ্রেনীতে ভাগ করা যায় মহাবিশ্বের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তারাদের: তারার বর্ণালীগত শ্রেণীবিভাগ (The Spectral Classification of Stars)

 

 

 

      হাবল টেলিস্কোপে তারা-ভরা আকাশ ( Image : NASA / Hubble)

 

ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি (European Space Agency – ESA) এর মতে , মহাবিশ্বে রয়েছে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন তারা। নিশ্চিতভাবে, প্রযুক্তি এবং মহাশূন্য গবেষণার উন্নতির সাথে সাথে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মহাবিশ্বের তারাগুলোকে কি নির্দিষ্ট কোনো  উপায়ে ক্যাটাগরিভুক্ত করা যায়? উত্তর হলো হ্যা ! মরগ্যান কিনান শ্রেণীবিভাগ পদ্ধতি (The Morgan Keenan Classification System) -যা পুরোনো হার্ভার্ড পদ্ধতি (Harvard System) এবং ইয়ার্কস পদ্ধতির ( Yerkes System) সমন্বয়ে গঠিত। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাক। 

 

তারার হার্ভার্ড শ্রেণীবিন্যাস

 

প্রথমত , হার্ভার্ড পদ্ধতি হলো নক্ষত্র শ্রেণীবিন্যাসের একটি এক-মাত্রিক পদ্ধতি , যেখানে তারাগুলোকে তাদের বর্ণালী অনুযায়ী ৭টি প্রধান ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় । এই শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তি হলো তারার পৃষ্ঠ তাপমাত্রা । তারার এই ৭টি বিভাগ, ৭টি ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে প্রকাশ করা হয় এবং এগুলো খুব গরম থেকে খুব শীতল বা ঠান্ডার পর্যায়ও নির্দেশ করে । পর্যায়গুলো : O , B , A , F , G , K , M.

এ শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী একটি O পর্যায়ের তারা খুবই উত্তপ্ত, যার পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা প্রায় ৫০,০০০ K (কেলভিন) এবং একটি M পর্যায়ের তারা খুবই ঠান্ডা তার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ২,৫০০ K. তারার পৃষ্ঠের তাপমাত্রার সাথে রঙও পরিবর্তিত হয় ।

 

          তারাদের শ্রেণিবিভাগ

 

খুব সহজে তারার ৭টি ক্রম বা পর্যায় মনে রাখার জন্য একটি বাক্যের সাহায্য নেওয়া যায়ঃ Oh Boy , A Funny Girl Kicked Me .

প্রত্যেক বিভাগের তাপমাত্রা এবং বর্ণালীগত বৈশিষ্ট্য ওপরের চিত্রে দেয়া আছে । এই বৈশিষ্ট্য একই সাথে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে বর্ণালীবিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ একটা উদাহরণ । এই ৭টি বিভাগ নিয়েই মূলত তারার শ্রেণীবিন্যাসের নকশা গঠিত হয়েছিল ‌। শীতল বা ঠান্ডা তারাদের অবলোহিত বর্ণালী শ্রেণীভুক্ত করার জন্য নতুন বর্ণালী পর্যায় L , T এবং Y  তৈরি করা হয়েছিলো । এই শীতল তারাদের মধ্যে রয়েছে লোহিত বামন এবং বাদামী বামন যারা দৃশ্যমান বর্ণালীতে খুবই অস্পষ্ট ।

L পর্যায়ের বাদামী বামনদের (L brown Dwarf) তাপমাত্রা প্রায় ১,৫০০ K থেকে ২,৫০০ K এবং এদের এমন বর্ণালীরেখার কারণ ক্ষারজাতীয় ধাতু যেমন : রুবিডিয়াম , সোডিয়াম এবং ধাতব যৌগ যেমন আয়রন হাইড্রাইড । T পর্যায়ের বাদামী বামনদের বিশেষ মিথেন শোষণ বর্ণালী রয়েছে এবং তাপমাত্রা প্রায় ৮০০ K থেকে ১,৫০০ K । Y পর্যায়ের বাদামী বামনদের তাপমাত্রা ৮০০ K থেকে কম এবং এদের বর্ণালীরেখা অ্যামোনিয়া থেকে পানি পর্যন্ত ।

 

    

একজন শিল্পীর চোখে: Y বামন

 

নক্ষত্রীয় শ্রেণীবিন্যাসে, প্রতিটি শ্রেণী আবার ১০টি ভাগে বিভক্ত । তাই, প্রত্যেক তারার জন্যই 0 থেকে 9 এর মাঝে যেকোনো একটি সংখ্যা থাকবে । উচ্চ তাপমাত্রার তারাদেরকে নিম্নসংখ্যার ধরা হয় । তাই একটি K0 তারা, K7 তারা থেকে অনেক উত্তপ্ত। জ্যোর্তিবিজ্ঞানে রঙের বর্ণনা একটি প্রচলিত প্রথা এবং তারার রংগুলো A শ্রেণীর তারার (এগুলোকে সাদা বলে বিবেচনা করা হয় ) রঙের সাথে  তুলনা করে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া, একজন পর্যবেক্ষক খালি চোখে অথবা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে অন্ধকার আকাশে যে তারা দেখে তা যদি বর্ণনা করতে চেষ্টা করে , তখন এই বিবরণকেবলা হয় আপাত আলোর বিবরণ। 

যাইহোক , অতিউজ্জ্বল তারা ব্যতীত আকাশের সকল তারাই খালি চোখে সাদা অথবা নীলাভ-সাদা  দেখা যায় কারণ তারাগুলো খুবই অস্পষ্ট। লোহিত অতিদানবেরা একই বর্ণালী পর্যায়ের অন্যান্য দানব থেকে অনেক ঠান্ডা বা শীতল এবং লাল হয়। বিশেষ বর্ণালী বৈশিষ্ট্যের তারা যেমন: কার্বন তারা যেকোনো কৃষ্ণবস্তু থেকে সম্ভবত অধিক লাল হয়।

 

তারার ইয়ার্কস শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি

 

নক্ষত্র শ্রেণীবিন্যাসে  তারার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনুযায়ী এগুলোকে শুধু একটি করে বর্ণমালা দিয়ে প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়। তারাগুলো বিভিন্ন আকারের হয় এবং বিভিন্ন বিবর্তনের ধাপে থাকে । প্রধান ক্রমের তারাগুলো (main sequence stars) এখনো তাদের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপন্ন করছে এবং শ্বেত বামনেরা তাদের জীবনের ইতি টেনেছে। তাই এদের পৃথক করার জন্য আমাদের অন্য একটি মাপকাঠি দরকার। আর সেটি হলো উজ্জ্বলতা (luminosity). জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে, উজ্জ্বলতা হলো, প্রতি সেকেন্ডে নির্গত মোট শক্তির পরিমাণ। উচ্চ মাধ্যাকর্ষণ বিশিষ্ট ভারী তারাগুলো প্রশস্ত বর্ণালী রেখা প্রদর্শন করে। একটি দানব বা দৈত্যাকার তারার পৃষ্ঠীয় মাধ্যাকর্ষণ  একটি বামন তারা থেকে অনেক কম হয় । কারণ সমান ভরের দানব তারার ব্যাসার্ধ, বামন তারার ব্যাসার্ধ থেকে অনেক বেশি হয়। সুতরাং উজ্জ্বলতার প্রভাব দিয়ে বর্ণালীর পার্থক্যকে ব্যাখ্যা করা যায় এবং উজ্জ্বলতার একটি বিভাগ বর্ণালী পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়। উজ্জ্বলতার বিভাগ বর্ণনা করা হলো:

             

 

               

        তারার  ইয়ার্কস শ্রেণীবিন্যাস 

 

 তারার মরগান কিনান শ্রেণীবিন্যাস

 

পরিশেষে, হার্ভার্ড পদ্ধতি এবং ইয়ার্কস পদ্ধতির সমন্বয়ের ফলে আমরা বর্তমান মরগান কিনান (MK) নক্ষত্রীয় শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি পাই। অতএব , প্রত্যেক তারাকে এর পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা অনুযায়ী একটি বর্ণালী শ্রেণীতে এবং পৃষ্ঠীয় মাধ্যাকর্ষণ অনুযায়ী একটি উজ্জ্বলতার শ্রেণীতে চিহ্নিত করা যায় । তাই আমাদের সূর্য একটি G2V তারা‌। এর পৃষ্ঠীয় তাপমাত্রা প্রায় ৫,৯০০ K এবং কেন্দ্রে হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম তৈরি করছে। সুতরাং সূর্য একটি প্রধান ক্রমের (V)  তারা। মহাবিশ্বের সব তারাকে একটিমাত্র রেখাচিত্রে অঙ্কণের মাধ্যমেই MK পদ্ধতির সৃষ্টি।

 

অনুবাদক

অর্ণব সুত্রধর 

পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগ (২০১৯-২০ ব্যাচ)

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


লেখক : Rishabh Nakra


মূল আর্টিকেল লিংক : https://www.secretsofuniverse.in/classification-of-stars-boa-9/

Leave a Reply