আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে, কোয়াসার একটি ভারী ও অত্যন্ত দূরবর্তী মহাকাশীয় বস্তু যা প্রচুর পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রে একটি কোয়াসার দেখতে নক্ষত্রের মতো হলেও এটি থেকে বিপুল পরিমাণে রেডিও তরঙ্গ বিকিরিত হয়।
একারণে প্রথমদিকে কোয়াসি-স্টেলার রেডিও সোর্স নামকরণ করা হয়েছিল যা এখন সংক্ষেপে কোয়াসার নামে পরিচিত। কোয়াসারগুলো অনেক উজ্জ্বল হয়। কখনও কখনও এতই উজ্জ্বল হয় যে, এরা যে গ্যালাক্সিতে অবস্থান করে সে গ্যালাক্সিকেই এদের উজ্জ্বলতার কারণে দেখা যায় না। এই শক্তিশালী বস্তুগুলো আবিষ্কারের পর থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করে আসছে। আজকের প্রবন্ধের লক্ষ্য এদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করা।
কোয়াসারের আবিষ্কার
রেডিও ও অপটিক্যাল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগের সবচেয়ে সফল ফলাফল ছিল কোয়াসারের আবিষ্কার। ১৯৩২ সালে আমেরিকান প্রকৌশলী কার্ল জানস্কি, সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা রেডিও তরঙ্গের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুজ্জ্বল মহাকাশীয় বস্তুগুলো থেকে রহস্যজনক রেডিও তরঙ্গ নির্গমনের কারণ খুঁজছিলেন।
ফলস্বরূপ, ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে প্রথম কোয়সার আবিষ্কৃত হয়েছিল। আগে কোয়াসারকে শুধুমাত্র রেডিও তরঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হত (যার সাথে সম্পৃক্ত কোন দৃশ্যমান বস্তু পাওয়া যেত না) ১৯৬৩ সালে, দৃশ্যমান বস্তু হিসেবে 3C 48 নামক রেডিও তরঙ্গের উৎস শনাক্ত করা হয়েছিল। রহস্যময় এই বস্তুর নাম দেওয়া হয় কোয়াসার।
কোয়াসারের গঠন এবং বৈশিষ্ট্য
বিজ্ঞানীদের মতে এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রায় গ্রহণযোগ্য একটি তত্ত্ব হচ্ছে অধিকাংশ বড় বড় ছায়াপথগুলোতে একটি করে সুপারম্যাসিভ কৃষ্ণগহ্বর থাকে। তত্ত্বীয়ভাবে, কোয়াসার এবং অ্যাক্টিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াইতে (AGN) কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে একটি গ্যাসীয় Accretion ডিস্ক ঘিরে থাকে। আসেপাশের গ্যাস যখন কৃষ্ণগহ্বরে পড়তে থাকে, শক্তি তখন তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ আকারে বিকিরিত হয়। যা আমরা সমগ্র তড়িৎচৌম্বকীয় বর্ণালী জুড়েই পর্যবেক্ষণ করতে পারি। কোয়াসারের বৈশিষ্ট্যসমূহ অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন কোয়াসার সম্পৃক্ত কৃষ্ণগহ্বরের ভর, কোয়াসারে গ্যাসের বৃদ্ধির হার, পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে অ্যাক্রিশন ডিস্কের অবস্থান, জেটের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি এবং ছায়াপথগুলোর মধ্যে গ্যাস-ধুলিকণার অস্পষ্টতা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।
শক্তিশালী অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণের কারণে কোয়াসার এবং সাধারন নক্ষত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে পার্থক্য করা যায়। সাধারনত মেইন সিকুয়েন্স নক্ষত্র কোয়াসারের মতো শক্তিশালী অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ করে না। কোয়াসার সক্রিয় ছায়াপথের মতো একই রকমের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য প্রদর্শণ করে। এগুলো তড়িৎচৌম্বকীয় বর্ণালীর অনেক অংশে থাকে, যেমন বেতার, অবলোহিত, দৃশ্যমান, অতিবেগুনী, এক্স-রে এমনকি গামা রশ্মিতেও দৃশ্যমান।
কোয়েসারের সকল ধরনের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ/বিশ্লেষণ করে ০.০৬ থেকে সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ ৬.৪ পর্যন্ত রেড শিফট পাওয়া গিয়েছে। কোয়াসারের ক্ষেত্রে রেড শিফটের মান ৩ থেকে বেশি হলে এই তথ্য প্রকাশ করে যে, কোয়াসারগুলো উচ্চ গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে এবং খুবই দূরে অবস্থিত।
কোয়াসারের উপপ্রকার
কোয়াসারের বিভিন্ন উপপ্রকারগুলো হলো :
বেতার সক্রিয় কোয়াসার (Radio-loud Quasars):
এসকল কোয়াসারে শক্তিশালী জেট পাওয়া যায় যা রেডিও-তরঙ্গের শক্তিশালী উৎস। এদের পরিমান সকল কোয়াসারের প্রায় ১০%।
বেতার নিষ্ক্রিয় কোয়াসার (Radio-quiet Quasars):
এসকল কোয়াসারে শক্তিশালী রেডিও জেট নেই অর্থ্যাৎ এরা তুলনামূলকভাবে দূর্বল রেডিও জেট নির্গমন করে। অধিকাংশ কোয়াসারই (প্রায় ৯০%) হলো বেতার নিষ্ক্রিয় কোয়াসার।
প্রশস্ত শোষণ-রেখা কোয়াসার (Broad absorption-line Quasars):
এসকল কোয়াসারের ব্লু শিফট হওয়া বর্ণালীতে প্রশস্ত শোষণ-রেখা দেখা যায়। প্রায় ১০% কোয়াসারে প্রশস্ত শোষণ রেখাগুলো দৃশ্যমান হয়। প্রশস্ত শোষণ-রেখা সাধারণত বেতার নিষ্ক্রিয় কোয়াসারে দেখা যায়।
Type II কোয়াসার :
এই ধরণের কোয়াসারে ঘন গ্যাস এবং ধুলিকণা, কোয়াসারের অ্যাক্রিশন ডিস্ক ও প্রশস্ত বিকিরণ-রেখাকে অস্পষ্ট করে তুলে।
রেডিস কোয়াসার (Red Quasars):
এ কোয়াসারগুলো সাধারন কোয়াসারের তুলনায় রেডিস হয়ে থাকে। এগুলো সম্ভবত কোয়াসারের হোস্ট গ্যালাক্সির মধ্যে মাঝারি মাত্রার ধূলিকণা বিলুপ্তির ফলাফল। অবলোহিত ব্যান্ডের তথ্য অনুসারে, লোহিত কোয়াসারগুলো মোট কোয়াসারের উল্লেখযোগ্য অংশ।
অপটিক্যালি ভায়োলেন্ট ভেরিয়েবল কোয়াসার (Optically Violent Variable (OVV) Quasars:):
বেতার সক্রিয় কোয়াসার যার জেটটি পর্যবেক্ষকের দিকে থাকে, নির্গমন জেটের আপেক্ষিক দিকের কারণে এধরণের কোয়াসারের উজ্জ্বলতায় তীব্র ও দ্রুত পরিবর্তনশীলতা দেখা যায়।
দুর্বল নির্গমন লাইন কোয়াসার (Weak emission line Quasars):
অতিবেগুনী বা দৃশ্যমান বর্ণালীতে এ কোয়াসারগুলো থেকে অস্বাভাবিকভাবে মৃদু নির্গমন রেখা পাওয়া যায়।
কোয়াসারের গুরুত্ব
একটি কোয়াসার অত্যন্ত দূরবর্তী, উজ্জ্বল এবং দেখতে তুলনামূলক ছোট প্রতীয়মান হয়। তাই আকাশে একটি স্থানাঙ্ক সিস্টেম (Co-ordinate System) স্থাপনে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও, কোয়াসার ইন্টারন্যাশনাল সেলেস্টিয়াল রেফারেন্স সিস্টেমের (আইসিআরএস) অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। বিজ্ঞানীরা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী, প্রায় ১৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের কোয়াসার চিহ্নিত করেছিলেন। J1342+0928 নামের কোয়াসারটি বিগ-ব্যাংয়ের মাত্র ৬৯০ মিলিয়ন বছর পর আবির্ভূত হয়েছিল।
এই প্রাচীন কোয়াসারগুলো সময়ের সাথে ছায়াপথের বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। আবার, কোয়াসার থেকে শক্তি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছাতে বিলিয়ন বছর লাগে। এই কারণে এদের জানার মাধ্যমে মহাবিশ্বের শুরুর দিকের তথ্য পেতে পারেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
অনুবাদক :
অর্ণব সুত্রধর
পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগ (২০১৯-২০ ব্যাচ)
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
লেখক : Simran Buttar
মূল আর্টিকেল লিংক: Quasars: The Most Powerful Objects In The Universe