সাহার সমীকরণ এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে এর গুরুত্ব

 

একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 

১৮১৪ সালে ফ্রনহোফার রেখা সমূহের (Fraunhofer Lines) আবিষ্কার, নক্ষত্রের বর্ণালী গবেষণার সূচনা করে। নক্ষত্রের বর্ণালী ফ্রনহোফার বর্ণালীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ মেনে চলে। দেখা যায় কিছু কিছু পদার্থের বর্ণালী অন্যান্য পদার্থের বর্ণালীর চেয়ে শক্তিশালী। মজার বিষয় হচ্ছে, নক্ষত্র ভেদে একই ধরনের পদার্থ থেকে ভিন্ন ভিন্ন শক্তির বর্ণালী পাওয়া যায়। এই অসামঞ্জস্যতার (ভিন্নতা) কারণ তখনকার বিজ্ঞানীরা জানতো না।

ফ্রনহোফার লাইনগুলোসহ সূর্যের বর্ণালী

ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া

পারমাণবিক এবং বিকিরণ তত্ত্ব আবিষ্কারের পূর্বে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা বর্ণালীবিন্যাসের এ ভিন্নতাকে নক্ষত্রের প্রাথমিক গঠনগত ভিন্নতার ফলাফল হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চাইতেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা জানি এই অসামঞ্জস্যতার আসল কারণ তাপমাত্রার ভিন্নতা। চলুন আজকে আমরা ইতিহাসের একটু গভীরে যাই, আমরা জানবো কিভাবে একজন ভারতীয় উপমহাদেশের (বর্তমান বাংলাদেশ) জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা নক্ষত্রের বর্ণালীর এ ধাঁধা সমাধান করেছিলেন।

মেঘনাদ সাহা

ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া

১৯২০ সালে সাহার আয়নীকরণ তত্ত্ব, বোর পারমাণবিক তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ তুলে ধরেছিল। আমরা জানি পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। কিন্তু পরমাণু পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি পেয়ে উত্তেজিত হলে ইলেকট্রন ছিটকে বেরিয়ে যায়, এই ঘটনাটিই মূলত আয়নীকরণ। সাহা একটি গাণিতিক সূত্র/সমীকরণ দিয়েছেন যেটা বর্ণনা করে কিভাবে নক্ষত্রের বায়ুমন্ডলের উত্তেজনা এবং আয়নীকরণ, আসলে নক্ষত্রের গঠন (Composition) ছাড়াও তাপমাত্রা ও চাপের উপর নির্ভর করে। সাহার এই সূত্রটিই নক্ষত্রের বর্ণালী (Stellar Spectroscopy) নামক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। আসুন এখন আমরা সাহার বিখ্যাত আয়নীকরণ সমীকরণটি বোঝার চেষ্টা করি।

সাহার সমীকরণের অর্থ:

নক্ষত্রের বর্ণালীবিন্যাস ব্যাখ্যায় সাহার সমীকরণটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং স্ট্যাটিস্টিকাল মেকানিক্সের সমন্বয়ে একটি কার্যকর ফলাফল। এই সমীকরণ থেকে আমরা গ্যাসের তাপমাত্রা ও চাপের সাহায্যে তাপীয় সাম্যাবস্থায় গ্যাসের আয়নীকরণ ডিগ্রী বের করতে পারি। আয়নীকরণ ডিগ্রী হলো তাপীয় সাম্যাবস্থায় আয়ন সংখ্যার ঘনত্ব (Number density of ions) এবং নিরপেক্ষ পরমাণুর সংখ্যার ঘনত্বের (Numberl density of neutral atoms) অনুপাত।

সাহার সমীকরণ,

[d][e]

সাহার সমীকরণ দেখায় কিভাবে গ্যাসের আয়নীকরণ ব্যাপারটি বিভিন্ন ভৌত পরিমাপকের (Physical Parameter) উপর নির্ভর করে, যেমন:

আয়নীকরণ শক্তি (Ionization energy)

গ্যাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলেও আয়নীকরণ ডিগ্রী কম থাকে, যতক্ষণ গ্যাসের তাপমাত্রা আয়নীকরণ শক্তির চেয়ে কম থাকে (উপরের এক্সপোনেনশিয়াল ফ্যাক্টর থেকে স্পষ্ট)।

তাপমাত্রা (Temperature)

গ্যাসের তাপমাত্রা আয়নীকরণ শক্তির চেয়ে বেশী হলে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে আয়নীকরণ ডিগ্রী হঠাৎ বৃদ্ধি পায়। এরপর গ্যাস প্লাজমা অবস্থায় পরিণত হয় (আয়ন, ইলেকট্রন ও নিরপেক্ষ পরমাণুর মিশ্রণ)।

আয়ন সংখ্যার ঘনত্ব (Number density of Ions)

যখন কোন পরমাণু চার্জিত হয়, তখন এটি পুনরায় ইলেকট্রন গ্রহণ বা ত্যাগের মাধ্যমে নিরপেক্ষ পরমাণুতে পরিণত হতে পারে। তারমানে ইলেকট্রনের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে নিরপেক্ষ পরমাণুর সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাবে ফলে আয়নীকরণ ডিগ্রী তত হ্রাস পাবে। সাধারণ হাইড্রোজেন প্লাজমায়, ইলেকট্রনের সংখ্যা আয়ন সংখ্যার সমান ধরা হয়। অতএব, যেহেতু প্লাজমায় আয়ন সংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, আয়নের নিরপেক্ষতার হারও বৃদ্ধি পায়। ফলে আয়নীকরণ ডিগ্রি হ্রাস পায়।

সাহার সমীকরণের ভৌত গুরুত্ব (Physical Significance)

সাহা দেখান যে গ্যাসের আয়নীকরণের ডিগ্রির ওপর চাপের প্রভাব অনেক । এ ব্যাপারটি তখন অপ্রত্যাশিত ছিল । ১৯২১ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির সভায় গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন । গবেষণাপত্রটিতে নক্ষত্রের বর্ণালীবিন্যাস ব্যাখ্যার জন্যে সাহা তত্ত্ব দেন।

তিনি যুক্তি দেখান ,

“আমরা একটি নক্ষত্রকে হাইড্রোজেন , হিলিয়াম অথবা কার্বন নক্ষত্র হিসেবে বললে সেটা ন্যায়সঙ্গত হবে না। বরং এই উপাদানগুলোকে নক্ষত্রের রাসায়নিক গঠনের মূল উপাদান হিসেবে বলা যায়। যথাযথ উপসংহার হলো , নক্ষত্রের প্রবল উদ্দীপনার অধীনে নির্দিষ্ট উপাদান বা উপাদানসমূহ বৈশিষ্ট্যগত রেখার বিকিরণ দ্বারা উত্তেজিত হয় , যেখানে অন্য উপাদানগুলোর আয়নীত হওয়া অথবা উদ্দীপনা এতটাই দূর্বল যে রেখাগুলোকে উত্তেজিত করতে পারে না ফলে আমরা এই উপাদানগুলো শনাক্ত করতে পারি না।’’[f][g]

সাহার সমীকরণ আরো বর্ণনা করে যে , একটি গ্যাস অতি উচ্চ তাপমাত্রায় এবং চার্জিত কণাসমূহের কম ঘনত্বে প্লাজমা অবস্থায় পরিণত হয়। একারণেই কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রী তাপমাত্রা এবং কম ঘনত্বের পরমাণুর (প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ১টি) উপস্থিতিতে নক্ষত্রে প্রাকৃতিকভাবে প্লাজমার অস্তিত্ব দেখা যায়। এটি প্রাকৃতিকভাবে ঘটার কারণে প্লাজমাকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।



অনুবাদক: 

সোলাইমান হোসেন

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এবং

অর্ণব সুত্রধর

পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়



মূল লেখক:        Rishabh Nakra

মূল রচনা:         THE SAHA’S EQUATION

 

Leave a Reply