প্রকৃতির শৈল্পিকতা: নীহারিকা

প্রকৃতির শৈল্পিকতা: নীহারিকা

প্রকৃতি কখনো আমাদের তার রূপে বিস্মিত করতে ব্যর্থ হয় না৷ প্রকৃতিতে তেমনই একটি সৃষ্টি হল নীহারিকা (Nebulae). তো আজকের ‘Basics of Astrophysics’ সিরিজের লেখায় আমরা নীহারিকার রূপ-গুণ-ধরন নিয়ে কিছুটা খোঁজখবর নেব।

নীহারিকাকে মূলত মহাজাগতিক মেঘ বলা যায়, যাতে ৯০% হাইড্রোজেন, ১০% হিলিয়াম আর সামান্য পরিমাণে অন্যান্য ভারী মৌল থাকে৷  ভূতুড়ে দেখতে এই গ্যাসের তৈরি মেঘগুলো বেশ উজ্জ্বল-রঙ্গীন থেকে একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্নও হতে পারে৷ নীহারিকাগুলো মহাবিশ্বের বিবর্তনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেহেতু এরা গ্রহ-নক্ষত্র তৈরির প্রাথমিক উপাদানগুলো ধারণ করে। রাতের আকাশে আলাদা আলাদা স্থান জুড়ে অথবা অন্য উজ্জ্বল বস্তুর সামনে ছায়ার মত এদের দেখতে পাওয়া যায়৷  

পর্যবেক্ষণীয় ইতিহাস: 

বিশাল নীহারিকাগুলোর পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে৷ দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি পাঁচটি নেবুলাস তারার* কথা বলেছিলেন৷ তারও ৮০০ বছর পর Abn Al-Rahman Suri ছোট একটা মেঘের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বর্তমানে সেখানে আমরা অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে দেখতে পাই৷ ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম টেলিস্কোপ দিয়ে নীহারিকা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন নিকোলাস ক্লড ফাব্রি ডি পেইরেস্ক, ওরিয়ন নীহারিকা শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে৷  পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে  বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা একের পর এক নতুন নীহারিকা শনাক্ত হলেও ১৯২০ সালে এডউইন হাবল নীহারিকার বাস্তব প্রকৃতি উন্মোচন করেন৷  

নীহারিকার শ্রেণীবিন্যাস :

নীহারিকাদের সাধারণত গ্যালাক্টিক ও এক্সট্রা-গ্যালাক্টিক এই দুইভাগে ভাগ করা হয়৷ এখনো পর্যন্ত এক্সট্রা-গ্যালাক্টিক নীহারিকা সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় নি । তবে গ্যালাক্টিক নীহারিকাগুলোকে আবার ডিফিউজড এবং রেগুলার নীহারিকায় বিভক্ত করা হয়েছে৷  

নীহারিকার প্রকারভেদ

ডিফিউজ নীহারিকা :

এই প্রকৃতির নীহারিকাগুলোর কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই৷ এদেরকে লুমিনাস এবং ডার্ক এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়৷  লুমিনাস নীহারিকাগুলো উজ্জ্বল এবং সহজেই এদের দেখতে পাওয়া যায়৷ এরা বিক্ষিপ্ত ও অনির্দিষ্ট আকারের৷ এদেরকে গ্যালাক্সিগুলোর সর্পিল বাহুগুলোতে দেখা যায়৷  

রিফ্লেকশন নীহারিকা :

রিফ্লেকশন নীহারিকা পাশে থাকা তারা বা জ্বলন্ত নীহারিকা (emission nebula)-র আলোয় আলোকিত হয়৷ যে বি টাইপ তারাগুলো অত্যন্ত উজ্জ্বল কিন্তু তাপমাত্রা ২৫হাজার কেলভিনের কম, সেগুলো নীহারিকার গ্যাসকে আয়নিত করতে পারে না। কিন্তু নীহারিকারা সে আলো ছড়িয়ে আলোকিত হতে পারে৷  

উদাহরণ: উইচ হেড নীহারিকা৷ 

উইচ হেড নীহারিকার ছবি

ইমিশন নীহারিকা :

গ্যালাক্টিক তলের কাছাকাছি বি১ দশার পূর্বের তারার সাথে ইমিশন নীহারিকার দেখা মিলে৷ অত্যন্ত গরম এই তারাগুলো শক্তিশালী অতিবেগুনী রশ্মি নির্গমন করে ইমিশন নীহারিকার গ্যাসকে আয়নিত করে রাখে যেটা ফ্লুরোসেন্স ইফেক্ট তৈরি করে। ফলে এই নীহারিকাগুলো থেকে আলো নির্গত হয়। 

ইমিশন নীহারিকাগুলো আবার দুই ধরনের।

H II রিজিওন :

H II রিজিওন হলো কম ঘনত্বের আংশিকভাবে আয়নিত গ্যাসের বিরাট একটা মেঘ যেখানে সম্প্রতি তারার জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ নীলতারাগুলো স্বল্পজীবনকালে আশেপাশের গ্যাসগুলোকে আয়নিত করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ অতিবেগুনী রশ্মি নির্গত করে৷ এজন্য এদের নামের সাথে নীহারিকাগুলোতে থাকা বিপুল পরিমাণের আয়নিত হাইড্রোজেনের নামের মিল আছে৷ H II রিজিওন মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার তারার জন্ম দিতে পারে৷ শেষের দিকে, সৃষ্টি হওয়া তারকাগুচ্ছে  সুপারনোভা বিস্ফোরণ এবং দৈত্যাকার তারা থেকে উৎপন্ন সৌরঝড় H II রিজিওনের অবশিষ্ট গ্যাসগুলোকে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়৷ ওই স্থানে রয়ে যায় জন্ম নেওয়া অসংখ্য তারারা৷ 

উদাহরণ: হার্ট এবং ঈগল নীহারিকা৷ 

RGB-তে হার্ট নীহারিকা, হাইড্রোজেন আলফা, এবং অক্সিজেন III.তোলা হয়েছে Celestron 9.25” EdgeHD with the Hyperstar V4. (তুলেছেন, Tim Connolly @astronorth.com)

সুপারনোভা র‍্যামনেন্টস :  

‘সাদা বামন তারা’ নামক নিবন্ধটিতে বলা হয়েছিল, বৃহৎ তারাগুলো জীবনের শেষপর্যায়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটায়৷ এতে তারার বাইরের স্তরটি বিস্ফোরিত হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে৷ এসব ছড়িয়ে পড়া অংশগুলোকে নিয়ে যে নীহারিকা তৈরি হয় তাকে সুপারনোভা র‍্যামনেন্টস বলে৷ এই গ্যাসীয় নীহারিকাগুলো সুপারনোভাতে ছড়িয়ে পড়া অংশ এবং সেই পথে থাকা মহাকাশীয় পদার্থ ও বিকিরণ (Interstellar Medium (ISM)) নিয়ে গঠিত৷ 

যদিও খালি চোখে দৃশ্যমান না, তবুও সুপারনোভা র‍্যামনেন্টস মহাকাশীয় পদার্থ ও বিকিরণের(ISM) সংস্পর্শে আসায় শক্তিশালি এক্স-রে ও রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করে৷ সুপারনোভার বিস্ফোরিত ভারীপদার্থগুলো মহাকাশীয় পদার্থ ও বিকিরণের সাথে মিশে যায়  যা পরবর্তী প্রজন্মের তারার জন্ম দেওয়ার সময় ব্যবহৃত হয়৷ 

উদাহরণ : ক্র‍্যাব-নীহারিকা, টরাস৷ 

ক্র্যাব-নীহারিকা, ছবিটি তুলেছেন,  Samara Nagle

ডার্ক নেবুলা/ অন্ধকার নীহারিকা :

এই নীহারিকাগুলো বেশ ঘন হওয়ায় এদের পিছনের দৃশ্যমান আলো রুখে দেয়৷ কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং জমাট বাঁধা নাইট্রোজেনে আচ্ছাদিত অতি ক্ষুদ্র কণাগুলোর জন্য মেঘগুলো পেরিয়ে কোনো আলো সামনে আসতে পারে না। ফলে এদের রঙ কালো, অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়৷ এদের গড় ঘনত্ব প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটারে ১০০-৩০০ মলিকিউল এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৭ থেকে ১৫ কেলভিন৷ মেঘের অভ্যন্তরের উপাদান অণু থেকে মাইক্রোওয়েভ রশ্মি ছাড়া কোনো কিছুই শনাক্ত করা যায় না৷ উদাহরণ : হর্স-হেড নীহারিকা। 

হর্স-হেড নীহারিকা, ছবিটি তুলেছেন  Samara Nagle

প্ল্যানেটারি নীহারিকা :

প্ল্যানেটারি নীহারিকাগুলো ইমিশন নীহারিকাদের মতো অনিয়মিত আকৃতির পরিবর্তে নিয়মিত আকৃতির হয়৷ এদের মধ্যভাগ খুবই উত্তপ্ত নীল তারার মত কেন্দ্রীভূত থাকে৷ আকৃতি অনেকটা তারার বাইরের দিকে বিস্তৃত বলয়ের মত। 

গ্রহের মতো গোলাকার হওয়ায় এদের প্ল্যানেটারি নীহারিকা বলা হয়। যদিও এদের সাথে গ্রহের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নাই৷ যখন বৃহদাকার বায়ুমণ্ডল ক্ষয়ে আসে, উত্তপ্ত ও আলোকিত কেন্দ্র থেকে অতিবেগুনী রশ্মি নির্গত পদার্থকে আয়নিত করে৷ শোষিত বিকিরণ তারার চারদিকের গ্যাসের স্তরকে আলোকিত করে৷ তৈরি হয় উজ্জ্বল নীহারিকা৷ উদাহরণ : এস্কিমো নীহারিকা৷

উদাহরণ : এস্কিমো নীহারিকা ক্রেডিট : NASA/ESA/STScI

অনুবাদক : সৌরভ মনি বিশ্বাস

পরিসংখ্যান বিভাগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

মূল লেখক :        Simran Buttar

মূল রচনা :         প্রকৃতির শৈল্পিকতা: নীহারিকা

Leave a Reply