তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে এর গুরুত্ব

তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে এর গুরুত্ব

আমরা তারা, গ্রহ, চাঁদ এবং সূর্য থেকে কয়েক কোটি কিলোমিটার দূরে বসবাস করলেও আমরা তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে এবং বুঝতে পারি – এটি একটি আশ্চর্যজনক বিষয়। আমি আজ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের একটি প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক টুল সম্পর্কে ধারণা দিতে যাচ্ছি যার নাম তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী। আমরা তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী কী এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে এর গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী

শৈশবে আমরা সকলেই তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর সাথে পরিচিত হয়েছি। আমরা হয়তো এটিকে রঙধনু হিসেবে সরাসরি দেখেছি অথবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ সম্পর্কে পড়েছি। কিন্তু এই রঙধনু সম্পূর্ণ তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর কেবলমাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র যাকে দৃশ্যমান অঞ্চল বলে। এবার আমরা সামগ্রিকভাবে তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী বোঝার চেষ্টা করব।

                                 তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী  (Image: Byju’s)

তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ 

 

বিকিরণ শক্তির একটি রুপ, যা তরঙ্গ এবং কণার আকারে চলাচল করে এবং যত অগ্রসর হয় তত ছড়িয়ে পড়ে। তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণকে ফোটন নামক ভরহীন কণার প্রবাহ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। প্রত্যেকটি ফোটন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ধারণ করে এবং এটি আলোর বেগে এবং তরঙ্গের মতো আকার তৈরি করে চলাচল করে।

সূর্য, নক্ষত্র এমনকি আমাদের বাড়ির টিউবলাইট থেকেও যে আলো আসে তা দৃশ্যমান তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণের একটি উদাহরণ তবে আগত আলোতে দৃশ্যমান তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ ছাড়াও অন্যান্য বিকিরণ রয়েছে। রেডিও স্টেশন থেকে যে রেডিও তরঙ্গ আসে তা রেডিও ট্রান্সমিশন এবং কমিউনিকেশনে সাহায্য করে। মাইক্রো-ওয়েভ রান্নাঘরে খাবার গরম করার কাজে ব্যবহৃত হয়। অতিবেগুনী রশ্মি স্কিন ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে পরিচিত। অবলোহিত/ইনফ্রারেড আলো, এক্স-রে এবং গামা রশ্মিও তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর অংশ যা আমরা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে থাকি। যখন আমরা শীতকালে বিকেলের সূর্য থেকে কিছুটা উত্তাপ পাওয়ার চেষ্টা করি, তখন আমরা সূর্যের তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণের অবলোহিত/ইনফ্রারেড অংশটি ব্যবহার করি। এছাড়াও আমরা দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত হাড়ের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য এক্স রে ব্যবহার করে থাকি।

                                   তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর সকল শ্রেণী এবং এদের প্রয়োগ

আমরা তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর বিভিন্ন অঞ্চল কীভাবে শ্রেণিবিভক্ত করি?

 

ফোটন থেকে প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ থেকে বিভিন্ন প্রকার তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ সংজ্ঞায়িত করা হয়। রেডিও তরঙ্গ নিম্ন-শক্তি সম্পন্ন ফোটনের সাথে সংশ্লিষ্ট, মাইক্রো-ওয়েভ ফোটন রেডিও-ওয়েভ ফোটনের চেয়ে একটু বেশী শক্তি সম্পন্ন, ইনফ্রারেড/অবলোহিত ফোটনেরও বেশি শক্তি, তারপর দৃশ্যমান, অতিবেগুনী রশ্মি, এক্স-রে এবং সবচেয়ে বেশি শক্তিসম্পন্ন গামা রে। রেডিও ওয়েভ থেকে গামা-রে পর্যন্ত কম্পাংক এবং শক্তি বৃদ্ধি পেলেও তরঙ্গদৈর্ঘ্য হ্রাস পায়।

জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর গুরুত্ব

বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ মূলত অ্যাস্ট্রোফিজিকাল বস্তুতে (যেমন: কৃষ্ণবিবর, নিউট্রন নক্ষত্র, ইত্যাদি) ঘটিত ভৌত প্রক্রিয়ার ফল। তাড়িতচৌম্বকীয় বিকিরণ শনাক্ত এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের দূরবর্তী স্থানগুলো সম্পর্কে জানতে পারি।

তাড়িতচৌম্বকীয় নিঃসরণকে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করে, যেসকল দূরবর্তী নক্ষত্র অথবা গ্যালাক্সির ব্যাপ্তি তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীর বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে রয়েছে (অর্থাৎ এক্স-রে, রেডিও তরঙ্গ, দৃশ্যমান এরকম বিভিন্ন অঞ্চলের বিকিরণ যখন একই বস্তু থেকে পাওয়া যায়), তাদের গঠন, কাঠামো এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিজ্ঞানীগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে থাকেন।

 

                                            কয়েকটি পরমাণুর বর্ণালী

জ্যোতিঃপদার্থবিদগণ নক্ষত্র এবং গ্রহের তরঙ্গদৈর্ঘ্যর বিন্যাস ব্যবহার করে এদের রাসায়নিক গঠন নির্ণয় করার জন্য স্পেক্ট্রোস্কোপির(বর্ণালী বিশ্লেষণ) টুল ব্যবহার করেন। সুতরাং তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালীই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি।

বায়ুমন্ডলের জন্য তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের যে সকল অংশ (রেডিও এবং দৃশ্যমান অঞ্চলের বিকিরণ ব্যতীত) পৃথিবীতে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয় – হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, কম্পটন গামা-রে অবজারভেটরি, চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি, স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপ এর মতো দূরবীক্ষণ যন্ত্র এবং ভয়েজারের মতো স্পেস প্রোব সে সকল বাধা সহজেই অতিক্রম করতে পারে (যেহেতু এগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে অবস্থিত) বিধায় এগুলো আমাদের গ্যালাক্সির দূরবর্তী অংশের তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।

মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনের জন্য জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার হচ্ছে বর্ণালী। বর্ণালী সম্পর্কে অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা প্রচুর তথ্য পেতে পারি। উদাহরণস্বরূপ : নাক্ষত্রিক বর্ণালী পর্যালোচনা করে আমরা এর রাসায়নিক গঠন, তাপমাত্রা, কাঠামো, দূরত্ব এবং ঘনত্ব জানতে পারি। এছাড়াও এটি দ্বারা পৃথিবীর সাপেক্ষে নক্ষত্রের আপেক্ষিক গতি নির্ণয় করা যায়। এই বিষয়ের একটি জনপ্রিয় শাখা হলো রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি। রেডিও বর্ণালী ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের রহস্যময় ও জটিল বস্তু যেমন ব্ল্যাক হোল, কোয়াসার এবং গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করে থাকেন।

অনুবাদক পরিচিতিঃ 

নুসরাত জাহান

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ (২০১৯-২০)

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক : Rishabh Nakra

Main Article Link : https://www.secretsofuniverse.in/the-em-spectrum/

Leave a Reply